১. অগ্রক্রয় কি?
অগ্রক্রয় অধিকার (Right of Pre emption) হলো পুনঃ কেনার অধিকার। জমি কেনাবেচার ক্ষেত্রে ক্রেতাদের মধ্য থেকে আইনে কিছু বিশেষ ক্রেতাদেরকে অন্যান্য ক্রেতাদের থেকে অগ্রাধিকার দেয়া হয়। অর্থাৎ কেউ যদি জমি বিক্রয় করে, সে জমি যারা কিনতে চাই, তাদের মধ্যে যিনি জমিটি কেনার অধিকার রাখে তাকে বিক্রয় না করে জমির মালিক যদি অন্য কাউকে বিক্রয় করে দেয় তাহলে উক্ত অধিকার প্রাপ্ত লোক পুনঃ সে জমি কিনতে পারবে। ইংরেজিতে একে প্রি-এমপশন (pre emption), আরবিতে সাফা বলে। এটি বিশেষ ধরনের একটি অধিকার।
সাধারণত, জমির মালিক তার জমি বিক্রি করতে চাইলে, প্রথমে অগ্রক্রয় অধিকারীদের বিক্রয়ের খবর জানাতে হয়। যদি তারা বিক্রয়ে আগ্রহী নাহয় তখন, বিক্রেতা অন্যান্য ক্রেতাদের জমি বিক্রি করতে পারবে। বিক্রয়ের খবর বা নোটিশ না দিয়ে বিক্রেতা জমিটি বাইরে বিক্রি করে দেয় তাহলে অগ্রক্রয় অধিকারী লোক সে জমি যাকে বিক্রি করা হয়েছে তার থেকে আদালতে প্রি-এমপশন মামলা দায়েরের মাধ্যমে পুনঃ বিক্রয় করে নিতে পারবে।
জমির শ্রেনী অনুযায়ী অগ্রক্রয় সম্পর্কিত বিধান একটু ভিন্ন ভিন্ন। যথা:
১. কৃষি জমির অগ্রক্রয়
২. অকৃষি জমির অগ্রক্রয়
কৃষি জমির অগ্রক্রয়
২. কারা অগ্রক্রয় দাবি করতে পারেন?
২০০৬ সালের সেপ্টেম্বর সংশোধনী অনুযায়ী অগ্রক্রয় অধিকার দাবি কারীদের আরো সীমিত করে নিম্নোক্ত দু শ্রেণীর লোককে অগ্রক্রয় অধিকার দেয়া হয়েছে। এছাড়া মামলা করার সময়সীমা ও চার মাস থেকে কমিয়ে দুই মাস করা হয়।
State Acquisition Tenancy Act, 1950 এর ৯৬ ধারা অনুসারে, পার্শবর্তী জমি ক্রয়ের ক্ষেত্রে যারা অগ্রাধিকার পাবেন তারা হলেন:
১. ওয়ারিশ সূত্রে সহ অংশীদার। অর্থাৎ, ক একখন্ড জমির ওয়ারিশ মূলে মালিক। তিনি এই জমিটি বিক্রয় করলে যারা ক এর মতো ওয়ারিশ সূত্রে পার্শ্ববর্তী জমির মালিক তারা। যেমন: ক এর ভাই, বোন বা অন্যান্য আত্মীয়গণ।
২. ক্রয়সূত্রে যারা সহ অংশীদার। অর্থাৎ, ক, খ, গ ও ঘ মিলে এক খন্ড জমি কিনল। এখন ক তার অংশটি বিক্রয় করতে চাই তাহলে খ, গ ও ঘ এই জমি কিনতে অন্য বহিরাগত ক্রেতাদের থেকে অগ্রাধিকার পাবেন।
২০০৬ সালের ২০ সেপ্টেম্বর থেকে আনীত সংশোধনীবলে উক্তরূপ দুই শ্রেণীর ব্যক্তি ছাড়া অন্য কেউ অগ্রক্রয় দাবি করতে পারবে না।
৩. আইনে অগ্রক্রয় অধিকার কেন দেয়া হয়?
কোন আগন্তুকের প্রবেশ ঠেকানোর জন্য এধরণের অধিকার আইনে বলবৎ আছে। আপনার পার্শ্ববর্তী জমিতে উত্তরাধিকারী বা বিক্রয় কবলা মূলে সহ মালিক বাদ দিয়ে অপরিচিত কেউ যেন আসতে না পারে সেজন এ ধরণের বিধান রয়েছে।
৪. কোন ধরণের জমিতে অগ্রক্রয় অধিকার প্রয়োগ করা যায়?
কৃষি জমি ও অকৃষি উভয় প্রকারের জমির অগ্রক্রয় দাবি করে আদালতে মামলা করা যায়। মহানগরী এলাকা, পৌরসভা এলাকা, হাটবাজার ইত্যাদি কে অকৃষি জমি হিসেবে গণ্য করা হয়। কৃষি জমির অগ্রক্রয়ের ক্ষেত্রে State Acquisition Tenancy Act, 1950 এর ৯৬ ধারা এবং অকৃষি জমির অগ্রক্রয়ের ক্ষেত্রে Non Agricultural Tenancy Act, 1949 এর ২৪ ধারা প্রযোজ্য।
৫. মামলা করার সময়সীমা/ কখন অগ্রক্রয় অধিকার সৃষ্টি হয়?
SAT Act, 1950 এর ৮৯ উল্লেখিত উক্ত জমির বিক্রয় নোটিশ পাওয়ার পরদিন থেকে ২ মাসের মধ্যে অথবা নোটিশ না পেলে উক্ত বিক্রয় সম্মন্ধে জানার পর থেকে। এবং জমি রেজিস্ট্রির তারিখ থেকে ৩ বছরের পর অগ্রক্রয় দাবি করে আর মামলা করা যাবে না। এই সময় নিয়ে অনেকে বিভ্রান্ত হতে পারেন। আসলে 'বিক্রয় সম্মন্ধে খবর পাওয়ার পর থেকে' এই কথাটির অর্থের ব্যাপকতা থাকায় ৩ বছরের আরেকটি সীমা টেনে দেয়া হয় যাতে মামলার সংখ্যাধিক্য কমে।
৬. কিভাবে অগ্রক্রয় অধিকার বাস্তবায়ন করা যায়?
অগ্রক্রয় অধিকারী ব্যক্তিকে আদালতে প্রি এমপশনের মামলা করতে হবে। মামলা করার সময় অবশ্যই তামাদির কথা মাথায় রাখতে হবে। কারণ, আইনে একটি নির্দিষ্ট মেয়াদ বা সময় নির্ধারিত থাকে যার ভিতরে মামলা না করলে তার অধিকার বিলুপ্ত হয়ে যায়। অর্থাৎ উপরে উল্লেখিত সময়সীমার পরে মামলা করলে সে মামলা আদালতে টিকবেনা (একে আইনের ভাষায় তামাদি বলে বারিত বলে)। এখতিয়ার সম্পন্ন আদালতে মামলাটি দায়ের করতে হবে। বিক্রীত জমির সব কবলা দলিলে উল্লেখিত মূল্যমান অনুযায়ী আর্থিক এখতিয়ার সম্পন্ন আদালতে মামলা করতে হবে। অর্থাৎ জমির মূল্যমান যদি ২ লক্ষ টাকার নিচে হয় 'সহকারী জজ আদালতে', ২ লক্ষ থেকে ৪ লক্ষের মধ্যে হলে 'সিনিয়র সহকারী জজ আদালতে', আর ৪ লক্ষের ঊর্ধে মূল্যমান হলে 'যুগ্ন জজ আদালতে' মামলা দায়ের করতে হবে। মামলা দায়ের করার সাথে সাথে আদালতে নিম্নে উল্লেখিত হিসাবে টাকা জমা দিতে হবে অন্যথায় আদালত মামলাটি খারিজ করে দিবে।
মামলা দায়ের করতে হলে আদালতে চার ধরনের টাকা জমা দিতে হয় অন্যথা মামলাটি আদালত খারিজ করে দেবে।
ক। সাব কবলা দলিলে উল্লেখিত জমির মূল্য
খ। উক্ত মূল্যের উপর বার্ষিক ২৫% হারে ক্ষতিপূরণ বাবদ
গ। উক্ত মূল্যের বার্ষিক সরল সুদে ৮% হারে
(২ এবং ৩ নং হিসাব করতে হবে দলিল রেজিস্ট্রির তারিখ থেকে মামলা দায়েরের সময় পর্যন্ত)
ঘ। প্রথম ক্রেতা কতৃক উন্নয়ন বাবদ অন্যান্য টাকা যা পরবর্তীতে আদালত সমীচীন মনে করলে জমা দিতে নির্দেশ দিবে
৭. অগ্রক্রয় মামলা কত দিনের মধ্যে করতে হবে?
কৃষি জমির অগ্রক্রয় মামলা করতে হবে বিক্রয় নোটিশ পাওয়ার পর থেকে বা বিক্রয় সম্পর্কে জানার ২ মাসের মধ্যে এবং অকৃষি জমির ক্ষেত্রে ৪ মাসের মধ্যে।
কোন আদালতে মামলা করতে হবে:
বিক্রীত জমির দখল উদ্ধারের জন্য যে আদালতে মামলা দায়ের করতে হতো সেই আদালতে প্রি এমপশনের মামলা করতে হবে।
৮. অগ্রক্রয় সম্পর্কিত আইন:
প্রথম Bengal Tenancy Act, 1885 এর ২৬ ধারায় অগ্রক্রয় সম্পর্কিত বিধান প্রণয়ন করা হয়। এ আইনটি কৃষকদের মুক্তির সূচনামূলক আইন হলেও অনেক ক্ষেত্রে আইনটি অকার্যকর ও অসম্পূর্ণ হওয়ায় আইনটি বাতিল করে ১৯৫০ সালে State Acquisition and Tenancy Act প্রণয়ন করা হয়। এ আইনের ৯৬ ধারায় অগ্রক্রয় সম্পর্কে বিস্তারিত বিধান প্রণয়ন করা হয়।
৯. আপিলের বিধান :
রাষ্ট্রীয় অধিগ্রহণ ও প্রজাস্বত্ব আইন, ১৯৫০-এর ৯৬(১২) ধারা অনুযায়ী আদালতের আদেশের বিরুদ্ধে একবার আপিল করা যাবে। কিন্তু ওই আপিলের রায়ের বিরুদ্ধে আর দ্বিতীয় আপিল করা যাবে না। তবে প্রথম আপিলের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে ১৯০৮ সালের দেওয়ানি কার্যবিধির ১১৫ ধারা অনুযায়ী Revision দায়ের করা যায়।
১০. অগ্রক্রয় সম্পর্কিত মুসলিম আইনের বিধান সমূহ প্রাসঙ্গিক মনে করায় নিম্নে সংক্ষিপ্ত আলোকপাত করা হলো:
আমার ধারনা, ইংরেজ আইনে অগ্রক্রয় ধারণাটি মুসলিম আইন থেকে এসেছে। কারণ মুসলিম আইনে পারিবারিক বা গোত্রীয় বন্ধন একটি গুরুত্ববহ ব্যাপার। মুসলিম আইনে তিন শ্রেণীর লোক অগ্রক্রয় দাবি করতে পারে। যথা:
ক) শাফি-ই-শরিক: উত্তরাধিকার বা ক্রয় সূত্রে সহ অংশীদার
খ) শাফি-ই-খালিত: যে জমির মধ্য দিয়ে বা সংলগ্ন পথ, পানির ড্রেন যাদের রয়েছে
গ) শাফি-ই-জার: সংলগ্ন জমির সত্ত্বাধিকারী
এছাড়া মুসলিম আইনে মামলার রায় হওয়ার পর টাকা জমা দিতে হয়।
অকৃষি জমির ক্ষেত্রে অগ্রক্রয়
কৃষি জমির অগ্রক্রয়ের যেসব বিধানাবলী উপরে আলোচিত হয়েছে অকৃষি জমির অগ্রক্রয় মামলার বিধান ও প্রায় একই। Non Agricultural Tenancy Act, 1949 এর ২৪ ধারাটি এক্ষেত্রে প্রযোজ। যে ভিন্নতা গুলো আছে সেগুলো নিম্নে উল্লেখ করা হলো।
১. মামলা দায়েরের তামাদি মেয়াদ ৪ মাসের মধ্যে।
২. আদালতে টাকা জমা দিতে হবে বিক্রীতমূল্য, ক্ষতিপূরণ বাবদ ৫% এবং প্রথম ক্রেতা কতৃক খরচ ও উন্নয়ন বাবদ যত টাকা এবং তার উপর সোয়া ৬% হারে সুদ
মনে রাখা দরকার কোন বসত ভিটা বিক্রয়ের ক্ষেত্রে কৃষি কিংবা অকৃষি জমির অগ্রক্রয় মামলা চলবেনা।
© লেখক কতৃক সর্বসত্ব সংরক্ষিত
লেখক: শহিদ রাসেল
আইনজীবী, চট্টগ্রাম জজ কোর্ট
13 মন্তব্যসমূহ
মাশাল্লাহ খুব উপকৃত পুষ্ট
উত্তরমুছুনঅগ্রক্রয় মামলা বাতিল করার উপায় কি জানালে উপকৃত হব
ভালো লিখেছেন।
উত্তরমুছুনমুসলিম আইনে অগ্রক্রয়ের তামাদির সময় লিখেন নাই। মুসলিম আইনে রেজিষ্ট্রেশনের কত দিনের মধ্যে মামলা করা যায় এবং শুনার কত দিনের মধ্যে মামলা করা যায়? জানালে জনগণ উপকৃত হত।ধন্যবাদ।
উত্তরমুছুনআমাদের পিতা-মাতা সহ সপরিবারে ৪০ বছরের ও অধিক সময় একটানা বসবাসের ঘর সহ জমি আমাদের পাশের দাগে বসবার করা আমার চাচাকে লিখে দিয়েছে আমাদেরকে কিছু না জানিয়ে। এখন ১৪৫ ধারায় মামলা ও করেছে, এখন আমরা কি আমানত করতে পারব?
উত্তরমুছুনধন্যবাদ। বিস্তারিত কমেন্টে লিখা সম্ভব না। কাগজপত্র দেখা লাগতে পারে। নিম্নোক্ত পেইজে ইনবক্স করুন https://www.facebook.com/mohammadlawfirm/
মুছুনবসতভিটা বিক্রির জন্য কৃষি ও অকৃষি অগ্রক্রয় মামলা চলবে না।মানেটা বুঝতে পারলাম না স্যার
উত্তরমুছুনস্যার আমি জমি দলিল করেছি প্রায়ই চার বছর হলো এখনো দলিল পায়নি গত ১৮/৫/২০২২ সালে পেনশন করছে এতে করে সে কি জমি টা পুনরায় ফিরে পাবে
উত্তরমুছুন? তবে বি এআরএস খতিয়ানে একটা দাগে মালিক একা আর বাকী দুই টা দাগে মালিক তার সৎ ভাই মালিক পেনশন করছে তার সৎ ভাই
স্যার আমার একটা সমস্যা হয়েছে আমার পিতার দাদিমার নাম BS খতিয়ানে আছে। কিন্তু উক্ত BS খতিয়ানে হিস্যা মতে ৮.৫০ শতক উনি জমি প্রাপ্ত হন। কিন্তু আমার পিতার দাদিমার ২ ছেলে ২ মেয়ে ওয়ারিশ আছে। উক্ত ওয়ারিশের ১ জন ছেলে উনার প্রাপ্ত হিস্যা মতে উক্ত খতিয়ানের আরেক জন রেকর্ডিয় মালিকের ছেলেকে বিক্রি করে ফেলেছেন। আর আমার পিতা হচ্ছে অত্র খতিয়ানের যার জমি বিক্রি করছে তার আপন নাতি। আমার পিতা কি অগ্রক্রয় মামলা করতে পারবে? স্যার উত্তরটা একটু জানালে উপকৃত হব।
উত্তরমুছুনবসত ভিটাতে কি অগ্রক্রয় মামলা করা যায়
উত্তরমুছুনআমার দাদারা তিন ভাই পৈত্রিক সূত্রে প্রাপ্ত ২৭ শতক জমি প্রত্যেকের ৯ শতক করে ভোগ দখল করতো। আমার ছোট দাদা ৩০ বছর আগে একজনের কাছে উক্ত ৯ শতক জমি বিক্রয় করছে কোন বন্টন নামা দলিল ছড়া, ৩০ বছর পরে এসে ওই লোক 2022 সালে আবার ওই জমিটি বিক্রি করছে। আমার দাদা বড় আমার বাবা পৈতৃক সূত্রে পাওয়া ৯ শতক জমি এখনো আছে দাগ নাম্বার ও একই। এখন আমার প্রশ্ন হল ওই ৯ শতক জমি আমরা কি অগ্রক্রয় করতে পারব পাশাপাশি একই দাগের জমি
উত্তরমুছুনআমি ২২/০২/২২ এ ৪৪ জমি ক্রয় করি এখন ১ বছর ৮ মাস পর বিক্রেতার ভাই কোর্টে মামলা করেছে জমি ফেরত পাওয়ার জন্য। উল্লেখ্য থাকে দলিলে ১ কোটি ২০ লক্ষ টাকা বাজার মুল্যের পরিবর্তে মৌজা দর ৫ লক্ষ ৭২ হাজার টাকা দলিলে দেওয়া হয়েছে এক্ষেত্রে আমার করনীয় কি?
উত্তরমুছুনমুসলিম আইনে অগ্রক্রয় এর মামলা করার জন্য কি জমি রেজিষ্ট্রি বাধ্যতামূলক।
উত্তরমুছুনএক খতিয়ানে আমরা ৩ ভাই ও ৬ বোন মালিক। কিন্তু উক্ত খতিয়ানে ভিন্ন ওয়ারিশ এর ২ জন ৪ শতক জায়গার মালিক। যারা আমাদের
উত্তরমুছুনরক্ত সম্পর্কের কেউ নয়।তবে তাদের থেকে আমাদের ১ভাই ২ শতক জায়গা ক্রয় করেন, উক্ত জায়গা দিয়ে আমাদের কে চলাচল করতে হয়।এখন কি আমি উক্ত ক্রয়কৃত জায়গার অর্ধেকের জন্য হক শফি মামলা করতে পারব।
If you have any question, please let me know.